Saturday, February 24, 2018

ভালোলাগায় দূরহ

ভালোলাগায় দূরহ
কাজী মোহাম্মদ শিহাবুদ্দীন (ম্যাজিশিয়ান কাজী) 

স্কুলে পড়ন্ত চোধুরী বাড়ীর চোধুরী সাহেবের একমাত্র কন্যা নওশীন চোধুরী। লেখাপড়ায় খুব মেধাবী ছিল বলে সবাই তাকে খুব ভালোবাসত। তার সহপাঠী বন্ধুরাও ছিল তার ভাইয়ের মত। সে ছিল খুব শান্ত মেজাজের অধিকারী আর ভীতু প্রকৃতির। তার পরিবার নামে বড় থাকলেও তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল শঙ্কটাপন্ন। তাদের ঘরে কোনো মতে দুই বেলা আহার জুটত। কিন্তু লেখাপড়ার জন্য যখন নওশীনের খুব চাপ পরে তখন সে খুব পরিশ্রম করার সত্তেও রেজাল্ট বের হত মন্দ। তাই শেষ পর্যন্ত তার কোচিং-এ ভর্তি অনিবার্য হল। অভাবের মধ্যে আবার মেজবান দেওয়ার মত তার বাবাকে কোচিং এর টাকাটা দিতে হয়। সারাদিন স্কুলের পর বিকেলের সময়টা ছিল কোচিং এর। কোচিং ছুটি হতে হতে প্রায় অন্ধকার নেমে আসত। এইভাবে সন্ধায় চলাচল তার জন্য খুব দুঃসহ হয়ে পরে। তবুও সে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। কিন্তু তাকে যখন পরতে হচ্ছে বিভিন্ন বাধায় তখন সে আত্নহারা হয়ে পরে কারন রাস্তায় যাতায়াতের সময় তাকে নিয়ে কটুক্তি করছে গ্রামের কিছু বখাটে ছেলেরা। এমনকি তারা তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সে তাতে রাজি নাহওয়াতে তারা তার সাথে নানান খারাপ ব্যাবহার করে এবং বলে তার সাথে অন্যকোন ছেলেকে দেখলে নাকি তারা তাকে হত্যা করবে। কিন্তু সে এসব সহ্য করে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। সে শুধু ভাবত, “আমার পিতার আশা আমাকে ডাক্তার বানানো তাই আমি আমার পিতার সেই আশা পূরন করব”। তার পিতাও তাকে কথা দিয়েছিল তাকে ডাক্তার বানাবে এবং তাকে দিয়ে গ্রামের সেবা করাবে। কিন্তু একদিন নওশীনের কোচিং এর মাস্টার একটু বিশ্রাম নেওয়ায় কোচিং ক্লাশ দেরিতে শুরু হয়। তাই নওশীন চেয়েছিল ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে আসতে কারন অন্ধকারে বাড়ি যেতে তার ভয় করে। কিন্তু স্যার
যেতে দেননী এবং বললেন, “আজ গুরুত্ত্বপূর্ণ কয়েকটা বিষয় নিয়ে আলচনা হবে”। তাই নওশীন সন্ধ্যার আগে বাড়ী যেতে পারেনি। স্যার যখন ছুটি দেন তখন প্রায় অন্ধকার নেমে আসল। নওশীনকে চিন্তিত দেখে তার খুব অন্তরঙ্গ  বন্ধু নিশাত প্রস্তাব রাখল, “আজ তোকে আমি বাড়ীতে পৌঁছে দেব, কোনো চিন্তা করতে হবেনা তোর”। কিন্তু নওশীন নারাজ কারন সে জানে তার সাথে কোনো ছেলেকে দেখলে বখাটেরা আক্রমন করবে। তবু নিশাত বলে, “আজ আমি যাবই যাব, আমাকে কেউ বাধা দিতে পারবেনা”। নওশীন যখন তার এই পরিস্থিতি দেখে তখন সে সব কথা খুলে বলে। কিন্ত তবুও নিশাত নাছোড় বান্ধা, সে বলে, “আমি এই সব ভয় পাই না, ভীতু কোথাকার আজ  যদি আমাকে না নিস তাহলে তোর সাথে বন্ধুত্ত বাতিল”। অবশেষে সে বলে  সে অর্ধেক পথ পর্যন্ত যাবে তবুও আজ সে নওশীনকে পৌঁছে দেবে। এভাবে শেষ পর্যন্ত দুজন একসাথে চলতে থাকে। নওশীন লক্ষ করল যে নিশাত আজ অন্যরকম কথাবার্তা বলছে এবং চলার পথে মাঝে মাঝে তাকে গান শোনাচ্ছে। নওশীন নিশাতের এই রূপ আগে কখনো দেখেনি। সে পুরপুরি মুগ্ধ কিন্তু কে জানতনা আজ তাদের দুজনের শেষ দেখা। অবশেষে অর্ধেক পথ যাওয়ার পর নওশীন থমকে দাড়াল এবং নিশাতকে বলল, “এবার তোমার যাওয়া শেষ কর এবং তুমি তোমার বাড়ীর দিকে রওনা হও”। কিন্তু নিশাত নারাজ, সে বলে, “এতদুর এসেছি আর বাকিটা গেলেই হত তোমাদের বাড়ী যেতাম, আর কোন খাবার চাচ্ছিনা শুধু এক ঘটি জল দিয়ে সারাদিনের তৃপ্তি মেটাবো ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি কতই নিষ্টুর আমাকে যেতে দিচ্ছনা। সকাল থেকে মুখে কিছুই দিনাই, আহা কি ভাগ্য আমার”। একথা শুনে নওশীনের মন গলে গেল, সে নিশাতকে আর বাধা দিলনা এবং দুজনে আবার পথ চলতে শুরু করল। যেতে যেতে কিছু দূর অতিক্রম করার পর দেখা হল বখাটেদের একজনের সাথে। সে তখন তাদের দিকে মেঘাচ্ছন্ন মুখে তাকিয়ে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করল এবং কেও একজনকে ফোন করে কি কথা বলল তার সাথে। এরপর হঠাৎ করে ইভটিজার ইভটিজার বলে চিৎকার করতে করতে বখাটে ছেলেগুলো ঝাপিয়ে পরে নিশাতের উপরে এবং নওশীনকে ওরা এক ধাক্কায় ফেলে দেয় মাঠে। নিশাতকে তারা লাঠি, লোহার দন্ড, বিভিন্ন রকম গাছের ডাল দিয়ে পেটাতে থাকে। নওশীন তাদের হাত থেকে নিশাতকে রক্ষা করতে না পেরে দৌড়াতে দৌড়াতে তার বাবার কাছে যায়। তার বাবা ঘটনাস্থলে আসতে আসতে বখাটেরা নিশাতকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে তার দেহটা মুমূর্ষ অবস্থায় রাস্তার মাঝখানে ফেলে পালিয়ে যায়। তার জ্ঞান ছিলনা, তাকে অজ্ঞান অবস্থায় নওশীনদের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ঠিক তখন সে নওশীন নওশীন বলে ডাকতে থাকে। নওশীনকে কাছে পেয়ে সে তার সজল দুনয়নে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “বড় ইচ্ছা ছিল তোমার বাড়ী দেখার কিন্তু সেটা আর হোলনা। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি নওশীন কিন্তু এই কথা আমি কোনদিন তোমাকে বলিনি এবং বুঝতেও দিনি। তুমিও যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আমাকে একটি বারের জন্য বুকে জড়িয়ে নাও এবং বল তুমিও আমায় ভালোবাসো”। এরপর নওশীন আর দেরি নাকরে নিশাতকে বুকে জড়িয়ে নিল এবং বলতে শুরু করল, “নিশাত আমিও তোমাকে খুব.........” এটুকু বলতে না বলতে নিশাত শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল তারপর ভালোবাসি শব্দটা উচ্চারণ করে কান্নায় ভেঙ্গে পরল নওশীন। এরপর নিশাতকে তাদের বাড়ীর সামনে দাফন করা হোল এবং একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপন করা হল সেখানে। নওশীন সারাদিন সারারাত সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকত। কিছুদিন পর নওশীনের বাবা তাকে বলল “মা” তুই আর স্কুলে যাসনা, এবার আমি তোর জন্য একটা ভাল পাত্র দেখব। তানাহলে নিশাতের মত তোকেও হারাতে হবে আমার।

No comments:

Post a Comment